নন্দিতা পাল

 




হিজিবিজি



পাতার পর পাতা হিজিবিজি কেটে যাচ্ছি। আমি রিনি। অফিসে ১০০০ পাতার হিজিবিজি জমা করতে হবে। তার মধ্যে ৫০০ টা গোল আছে যেখান থেকে হিজিবিজি একটুও বাইরে বেরোবে না।  এইটা হয়ে গেছে  সমস্যা। সমস্যা গোলের মধ্যে হিজিবিজি কিছুতেই থাকছে না। আমার কাছে আর ৬ টা দিন।  হিজিবিজি করতে আর ভালো লাগছে না। হাত পা টান করে শব আসন গ্রহণ করলাম।  মাথার ভেতরে শুধু হিজিবিজি চলছে। এই হিজিবিজি জমা দিলে আমি ১৫০০০ টাকা পাবে। খাতা পেন নিয়ে এই ১৫০০০ টাকার একটা হিসেবে কষে নেওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। আমাজন ঘাটা , ফেসবুকের ব্যবসা পাতায় ঘোরাঘুরি করা, কিন্তু এসব কোনো কিছুই টানছে না আমাকে। ১৫০০০ টাকা দিয়ে আমি কি  করবে একটা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর উত্তর গোল আর হিজিবিজি মেলাতে সাহায্য করলেও করতে পারে। আবার চেষ্টা শুরু করলাম আমি গোলের মধ্যে হিজিবিজি করা। কিন্তু সমস্যা হলো চোখের দুটি টেকটোনিক প্লেট সংঘর্ষ করতে এগিয়ে আসছে।  দুপুরের মিঠে রোদ এ গা এলানো থেকে নিজেকে আটকাতে পারলাম না। টেকটোনিক প্লেট ভেঙে ঘুমের হিমালয় ধপ করে উঠে গেলো। মাথায় তখনও একই চিন্তা ৬ দিনে এই পুরো হিজিবিজি সম্পূর্ণ করতে হবে।



ঘড়ির টিকটিক শব্দ খুব জোরালো হয়ে উঠছে। একটা টিক টিক এ একটা একটা বছর যাচ্ছে।  আর আমি তলিয়ে যাচ্ছি। পাশে ফোন টা ভ ভ করে কাঁপছে। এটা সানিধ্য।  এই সময় সানিধ্য ফোন করে অভস্ত্য হয়ে গেছে। ফোন টা  ধরতে চাইছি কিন্তু পারছি না। হাত পা এর ওজন কয়েক মন বেড়ে গেছে। কেউ আমাকে প্রোপোফল ইঞ্জেক্ট করেছে মনে হচ্ছে। হাত পা সবটাই অসার। আমার ব্রেন  এখন আরো কথা বলছে। মুখ নড়ছে না। মাথা আস্তে আস্তে দুলছে। আমি নামতে নামতে পৃথিবীর কেন্দ্রে পৌঁছে যাবো এবার। শুধু  নামছি।



আমার সুষুন্মাকান্ড হয়ে কিছু একটা উজ্বল আলো ব্রেন স্টেম থেকে সবকটা ইন্টারমিডিয়েট নার্ভ গুলোকে জ্বালিয়ে রেখেছে। সেই উজ্বল আলোটা ছড়িয়ে যাচ্ছে।  সবকটা কেমন হিজিবিজির মতন।  একটা নার্ভ জ্বলেই রয়েছে। সেটা সবসময় আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে গোলের মধ্যে হিজিবিজি  ধরাতেই হবে।  আর একটা প্রশ্ন ১৫০০০ টাকাটা দিয়ে আমি কি করবো? আচ্ছা যদি কোনো গরিব কে দিয়ে দি , তাহলে সেটা তার কতটা উপকার করবে? সেদিক থেকে এইটা খুব ছোট খাটো পরিমান। আর যদি ইকমার্সএর ওয়েবসাইট এ খরচ করা যেত. আজকাল সেখানে গোবর থেকে সোনা সবই পাওয়া যায়।  কিন্তু সমস্যা সেখানে আমার মনের মতো জিনিস নেই।  জানিনা হার্ট এর সাথে যুক্ত নার্ভটা ঠিক কোন সিগন্যাল এ জ্বলবে। উজ্বল আলোটা আরো ছড়িয়ে পড়ছে।



উজ্জ্বল আলোটা আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। উদ্বেগ মাথায় বাড়ছে। ই কমার্স এর ওয়েব সাইট এ একটি মেয়ে কথা বলছে।  সে কথা বিক্রি করছে। সে কথারই এমন বিজ্ঞাপন সাজিয়েছে তা অদ্ভুত ভাবে আমার নার্ভ গুলোর জ্বলন বাড়িয়ে দিচ্ছে।  মেয়েটি কথা কিভাবে বিক্রি করা যায় তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে চলেছে। ক-অ-থ-আ এইভাবে ভেঙে ভেঙে উচ্চারণ করছে সে। কখনো কথা থেকে ক উড়িয়ে দিচ্ছে আবার কখনো থ উড়িয়ে দিচ্ছে।  আর অদ্ভুত ভাবে বিজ্ঞাপন শেষে মেয়েটি চুপ হয়ে যাচ্ছে। আসলে আমার মাথা এখানেই দিশা হারিয়ে ফেলছে , সে আদৌ কথা বলা শেখাচ্ছে না , কথা বলা কিভাবে ভুলে যেতে হয় তা শেখাচ্ছে। তাই বিজ্ঞাপন আকর্ষণীয় হলেও জিনিস নিয়ে সন্দেহ জন্মাল।  বিজ্ঞাপন দিয়ে কথা বন্ধ করা যাবেনা।  মাথার মধ্যে বিপ্লব চলছে।



এদিকে সানিধ্য ফোন করেই চলেছে।  ফোনটা ভোঁ ভোঁ করছে। আজকাল সানিধ্য শুধু কথা বলে।  তাও  আবার সত্যি কথা। এতো সত্যি কথা যে ওর কাছে কে শুনতে চেয়েছে তা আমি জানিনা। জানিনা আমি কেন ওকে বলেছিলাম " আর যাই হোক কোনোদিন আমায় মিথ্যে বলবিনা। " ও বোধয় ওটাকে বেদবাক্য করে নিয়েছে।  দুনিয়ার কাউকে ও সত্যি বলার জন্যে পায় না।  মাঝে মাঝে কথা গুলোর মানে খুঁজে পাইনা। এতো সত্যি বলছে কেন কারণও খুঁজে পাইনা। তখন সবটাই হিজিবিজি মনে হয়। আমি হিজিবিজির  জালে শুধু জড়িয়ে পড়ছি। হয়তো ও কোনো দিনও মিলিয়ে যাবে সত্যির হিজিবিজির জালে। বা হয়তো আমরা দুজনেই জড়িয়ে যাবো। আর গোলের বাইরে বেরিয়ে যাবো। আমি কিছুতেই গোলের মধ্যে হিজিবিজি দিয়ে ভরাতে পারছিনা। একটু হলেও বেরিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন একটাই ১৫০০০ টাকা দিয়ে আমি কি করবো।



আমি এক আলোকবর্ষ পেরিয়ে যাচ্ছি বোধহয়।  চারিদিকে মহামারী লেগেছে।  এই ১৫০০০ মহামারী থামানোর জন্যেও খুব অল্প।  কত কিছু চারিদিকে কত ভাবনা কত চিন্তা। যেখানে আমার ১৫০০০ অনেক ছোট।  কিন্তু তাও এটাও হয়তো কাজে লাগবে।  এখন তার উত্তর পাওয়া না গেলেও তা কাজে লাগবে।  মাথাটা হিজিবিজি তে ভরে গেছে। মাথার দুপাশটা দারুন ব্যাথা করা শুরু করেছে। আমি শুধু ডুবে যাচ্ছি।  কবরটা খুব গভীর।  এতো গভীর বছরের পর বছর মাটি ফেলা হচ্ছে তাও ভরছেনা। এতো গভীরে আমি কক্ষনো যায়নি। আমি কঙ্কালে পরিণত হয়ে যাচ্ছি। মাথার ভেতর আলো  গুলো সব নিভে  আসছে। আর ওই জোরালো আলোটা একটা ছোট বিন্দুতে পরিণত হয়েছে।



তখনি হঠাৎ কে আমার পা টা ধরে নাড়িয়ে দিলো।  আর হঠাৎ জেগে উঠলাম। পাশে ফোনটা বেজেই চলেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সবে ৫ মিনিট সময় এগিয়েছে।  মা বাইরে কারোর সাথে রীতিমতো ঝগড়া করছে। "এই টুলটার জন্য আমি এতগুলো কাপড় দেবোইনা। " বাবা পুজো করতে করতে বলছে - "এতো বেলা হয়ে গেলো এখনো স্নানে গেলোনা।" আমি অগত্যা আলসেমি ছেড়ে আবার হিজিবিজি ভরাতে বসলাম। এই হিজিবিজি গোলের বাইরে চলেই যাচ্ছে। এটা আমাকে করতেই হবে। এই ১৫০০০ টাকাটা আমার দরকার কোনো এক হিজিবিজি কারণে।



মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন